![]() |
সনাত জয়সুরিয়া ছবি-সংগৃহিত |
সনাথ জয়সুরিয়া শ্রীলঙ্কান একজন ক্রিকেটার। জয়সুরিয়া
শ্রীলঙ্কা তো বটেই সারা ক্রিকেট বিশ্বের একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড়। তিনি ছিলেন
একাধারে মারমুখী বাহাতি ব্যাটার, বামহাতি অর্থডক্স স্পিনার এবং দারুন তৎপর একজন
ফিল্ডার। বিশেষ করে সীমিত অভারের ক্রিকেটে তিনি ছিলেন বোলারদের
জন্য এক আতঙ্ক। তিনি মুলত ইনিংসের ওপেনিং ব্যাটসম্যান
হিসেবে ক্রিজে আসতেন। আসার সাথে সাথে চার ছয়ের ফুলঝুরি ছড়াতেন উকেটের চারপাশে। তার বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ের জন্য তাকে
“মাতারা হারিকেন” নামে অবহিত করা হত। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে তিনিই
একমাত্র প্লেয়ার যে ১০০০০ প্লাস রান
করেছেন এবং ৩০০ প্লাস উইকেট লাভ করেছেন।
জয়সুরিয়া ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ১৯৮৯
সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে । আর টেস্ট ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ১৯৯১ সালে
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। তিনি ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ক্রিকেটে তার প্রভাব খুব
বেশি দেখাতে পারেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে তার জাত চিনিয়েছেন।
জয়সুরিয়া ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে ক্রিকেটে এক
বিপ্লব ঘটান। ইনিংসের শুরুতে বিদ্ধংসী ব্যাটিং করে ফিল্ডিং সীমাবদ্ধতা কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষের
বোলারদের তুলোধুনা করে নিজ দলের জয়ের ভিতকে শক্ত করা জায় তা জয়সুরিয়া সর্বপ্রথম
বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন । বলা যায় তার হতে ধরে আধুনিক ক্রিকেটে পাওয়ার প্লেকে কাজে
লাগানোর ধরণা ক্রিকেটে প্রবর্তিত হয়। যদিও ১৯৯২ সালে মার্টিন ক্রো
প্রথম ১৫ অভারের ফিল্ড রেস্ট্রিকশনকে কাজে লাগানোর কথা বলে মার্ক গ্রেট ব্যাচকে
ব্যবহারের চেষ্টা করেন তবে ১৯৯৬ সালে সনাথ জয়সুরিয়া অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান ইনিংসের
শুরুতে বোলারের উপর চড়াও হয়ে দলের রানকে বাড়িয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে । ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে তার অনবদ্য অলরাউন্ড পারফমেন্সের জন্য ম্যান অব
দ্যা টুর্নামেন্ট হিসেবে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। তার বিশ্বকাপের এই পারফরমেন্সের
কারনে পরের বছর ১৯৯৭ সালে উইজডেন ক্রিকেটার অফ দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন।
জয়সুরিয়ার প্রিয় শট ছিলো কাট এবং পুল যদিও
তিনি তার ট্রেডমার্ক শর্ট কাভারের উপর দিয়ে বাসিয়ে কাট শর্ট খেলা দুচোখ ভরে দেখতো
ক্রিকেট ভক্তরা। তিনি ১৫০ প্লাস ওয়ানডে ইনিংস খেলেছেন ৪ বার। তার সীমিত
ওভারের ৪৪৫ টি ম্যাচ খেলেছেন ম্যাচে
ব্যাক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস ১৮৯। এই ১৮৯ রানের ইনিংস তিনি খেলেছিলেন ভারতের বিপক্ষে
২০০০ সালে সারজাতে। ওয়ানডে ক্রিকেটে মোট রান ১৩৪৩০ রান। তার গড় স্ট্রাইক রেট ছিলো ৯০ এর বেশি ।তার মধ্যে
২৮ টি সেঞ্চুরি এবং ৬৮ টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে। তার আক্রমনাত্মক ব্যাটিং এর প্রভাব
এতটাই বেশি ছিলো যে জয়সুরিয়া যে
ম্যাচে ৫০ বা তার বেশি রান করেছেন সেই সব ম্যাচের ৭৫ ভাগ ম্যাচ শ্রীলঙ্কা জিতেছে। সেই সময়ের বাঘা বাঘা সব বোলারকে তিনি ফেস করে এই কীর্তি গড়েছেন।
ওয়াসিম আকরাম, গ্লেন ম্যাগ্রা, শেন ওয়ার্ন, কার্টলি এম্ব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশের মত
বোলারকে তিনি মুকাবিলা করেছেন তার ক্যারিয়ারে।
দ্রুত গতির হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড প্রথম তিনিই
গড়ে ছিলেন। পাকিস্থানের বিপক্ষে ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েন যা প্রায় ১৯
বছর স্থায়ী ছিলো। তিনি ৪৮ বলে সেঞ্চুরি পুর্ন করেন যা শ্রীলঙ্কান হিসেবে এখনো
রেকর্ড হয়ে আছে। বিশ্ব ক্রিকেটে তিনি একমাত্র প্লেয়ার যিনি পর পর দুই
ম্যাচে ১৫০ প্লাস রান করেছেন। তিনি প্রথম ওডিয়াই
ক্রিকেটে এক ওভারে ৩০ রান সংগ্রহ করেন পাকিস্থানের বিপক্ষে বোলার
ছিলেন আমির সোহেল। এছাড়াও ২০০১ সালে ক্রিস হ্যারিসের এক ওভারে ৩০ রান সংগ্রহ করেন
সনাথ জয়সুরিয়া। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার
হার্শেল গিবস জয়সুরিয়ার রেকর্ড ভেঙ্গে
দেন। জয়সুরিয়া ৪৪৫ ওডিয়াই ম্যাচে ২৭০ টি ছক্কা মেরেছিলেন যা একটি রেকর্ড ছিলো। ২০১০
সালের এশিয়া কাপে সেই রেকর্ড ছাপিয়ে যান পাকিস্থানের বুম বুম আফ্রিদি। ২০০৭ সালের
বিশ্বকাপে জয়সুরিয়া ২টি সেঞ্চুরি ও ২ টি হাফ সেঞ্চুরি করেন।
জয়সুরিয়া ওপেনিং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে
ব্যাটার হিসেবে সকল ফরমেট মিলিয়ে করেছেন ১৯২৯৮
রান যা একটি বিশ্বরেকর্ড।
বোলার হিসেবে জয়সুরিয়া ওডিআই ক্রিকেটে ৩২৩
উইকেট লাভ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ২৯ রানে ৬ উইকেট। যেটি তিনি পেয়েছিলেন ১৯৯৩
সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তিনি
মাত্র ১২ রানে ৩ উইকেট লাভ করেন জয়সুরিয়া। যেখানে শ্চিন টেন্ডুল্কার ও সঞ্জয়
ম্যাঞ্জেকার জুটি শ্রীলঙ্কাকে রীতিমত হুমকি দিচ্ছিল জয় কেড়ে নেওয়ার জন্য। তখনিই
জয়সুরিয়া উইকেটের পতন ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কাকে জিতিয়ে ফাইনালে নিয়ে যান তিনি। আর সেই
ফাইনাল ম্যাচ জিতে শ্রীলঙ্কা অপরাজিত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
তিনি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন মোট ১১০ টি। মোট
উইকেট পেয়েছেন ৯৮ টি। তিনি ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৯ উইকেট নেন।
জয়সুরিয়া মোট টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ১১০ টি রান
করেছেন ৬৯৭৩ রান। ১৪ টি সেঞ্চুরি ৩১ টি
হাফ সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। তার টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত সংগ্রহ ৩৯০
রান। যা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার হিসেবে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। এই ইনিংস তিনি খেলেছিলেন
১৯৯৭ সালে ভারতের বিপক্ষে। যা ভারতের বিপক্ষে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত রানের
ইনিংস। তিনি এই ইনিংস খেলতে মোট ৭৯৯ মিনিট
ব্যাট করেছিলেন। ঐ সিরিজের পরের টেস্ট ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৯৯ রানের
অনবদ্য ইনিংস। ঠিক তার পরের বছর ১৯৯৮ সালে অভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঝড়োগতির ২১৩
রানের দুর্দান্ত ডাবল সেঞ্চুরি করেন । বলা যায় তার ডাবল সেঞ্চুরির জন্যই শ্রীলঙ্কা
ঐ টেস্ট ম্যাচে জয় লাভ করে। ২০০৪ সালে পাকিস্থানের ফয়সালাবাদে পাকিস্থানের সাথে
টেস্ট ম্যাচে তুলে নেন আরো একটি ডাবল সেঞ্চুরি। সেদিন তিনি ২৫৩ রানের ইনিংস খেলেন
যে ম্যাচে শ্রীলঙ্কা জয় লাভ করে।
তিনি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন মোট ১১০ টি। মোট
উইকেট পেয়েছেন ৯৮ টি। তিনি ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৯ উইকেট নেন।
টিটুয়েন্টি ম্যাচ জয়সুরিয়া খেলেছেন ১১১ টি
যার মধ্যে ১ টি সেঞ্চুরিশ ১২ টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে।
ঠিক
যেমন চাদেরও কলঙ্ক থাকে জয়সুরিয়ার
ক্যারিয়ারেও আছে কিছু বিতর্কের ছাপ। ২০১৭ সালে তার সাবেক গার্ল ফ্রেন্ড মালিকা সিরিসেনার
সাথে যৌন সম্পর্কের তথ্য সোসাল মিডিয়ায় ফাস হওয়ায় তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। ঘটনাটি
২০১২ সালের। তার বিবাহিত স্ত্রী সান্দ্রে দি সিলভা থাকা সত্বেও তিনি মালিকার সাথে
ডেটে যান। সেই ঘটনার ফলাফল ডিভোর্স পর্যন্ত গড়ায়।
২০১৮ সালে আসিসি জয়সুরিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি বিরোধী কোড ভঙ্গের কারনে অভিযোগ আনে। নির্বাচিক কমিটির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যে ওয়ান্ডে ম্যাচের দুর্নীতি তদন্তে জয়সুরিয়া সহজোগিতা না করায় তাকে দুই বছরের জন্য ক্রিকেটের সকল রকম কার্যক্রমে অংশগ্রহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
জয়সুরিয়া
শ্রীলঙ্কার মাতারা জেলায় জন্মগ্রহন করেন। তিনি ২০১০ সালে
রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
সেই মাতারা জেলার প্রতিনিধি হয়ে “ইউনাইটেড পিপলস ফ্রডম অ্যালায়েন্স”
পার্টি থেকে ২০১০ সালের শ্রীলঙ্কান সাধারন নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি
২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার পোস্টাল সার্ভিস বিভাগের ডেপুটি
মিনিস্টার এবং ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি
মিনিস্টার হিসেবেও কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ